ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পটভূমি আলোচনা করো।
ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পটভূমি |
খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকে ইউরোপে প্রচলিত পোপতন্ত্র এবং রোমান ক্যাথলিক চার্চের কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, দুর্নীতি, অনাচার ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এক তীব্র সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। খ্রিষ্টান ক্যাথলিক চার্চ-বিরোধী এই আন্দোলন ‘ধর্মসংস্কার আন্দোলন’ নামে পরিচিত। কোন কোন ঐতিহাসিক এই ঘটনাকে ‘ধর্মবিপ্লব’ বলেও অভিহিত করেছেন।
ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পটভূমি :
কোন একটি নির্দিষ্ট কারণে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়নি। এর পিছনে ছিল বিভিন্ন রকমের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কারণ।
১) নবজাগরণের প্রভাব :
খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকের ইউরোপে, বিশেষ করে ইতালিকে কেন্দ্র করে, ইউরোপীয় চিন্তা-জগতে ‘নবজাগরণ’ ঘটে। ফলে মানুষ যুক্তিবাদী হয়ে ওঠে। এই যুক্তিবাদী মানুষের মধ্যে স্বাধীনচিন্তা, সমালোচনামূলক মনোভাব, ব্যক্তি স্বাধীনতা ইত্যাদি গড়ে ওঠায় তারা গির্জার দুর্নীতি, অনাচার ও স্বৈরাচারী মনোভাব-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস পায়।
২) স্কুলমেন দর্শনের প্রভাব :
ইউরোপে একাদশ দ্বাদশ শতকে খ্রিস্টানধর্মকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেন একদল দার্শনিক। এঁরা ‘স্কুলমেন’ নামে পরিচিত। এই মতবাদের জনক আর্চ বিশপ অ্যানসেলম ও তাঁর অনুসারীরা অভিজ্ঞতাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং যুক্তিবাদকে কাজে লাগিয়ে মানুষের ধর্মীয় জীবন ও চার্চকে শক্তিশালী ও সুসংহত করে তোলার চেষ্টা করেন। ফলে ধর্মসংস্কারের পথ উন্মুক্ত হয়।
৩) চার্চের দুর্নীতির প্রভাব :
খ্রিস্টান ধর্মগুরুরা বাইবেলের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষের উপর নিত্যনতুন করের (যেমন, ধর্ম কর ‘অ্যানেট’) বোঝা চাপিয়ে দিতেন। স্বর্গে যাওয়ার জন্য ‘পাপ মুক্তিপত্র’ (ইন্ডালজেন্স) বিক্রি করতেন। ধর্মের নামে এই অনাচারের বিষয়টি মুক্তচিন্তার মানুষেরা মেনে নিতে পারেননি।
৪) পোপের আধিপত্য :
একাদশ শতক থেকেই কয়েকজন পোপের সর্বগ্রাসী ক্ষমতালিপসা, সম্রাটদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও ঘৃণ্য কূটনীতির আশ্রয় গ্রহণের বিষয়গুলো জনগণকে বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। পেপের হাতে পরাজিত সিসিলির রাজা কনরাডিনের প্রকাশ্যে হত্যাকান্ড খ্রিস্টান দুনিয়ায় ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
৫) ক্রুসেডের ব্যর্থতা প্রভাব :
পোপেদের ডাকা ক্রুসেডগুলির ব্যর্থতা এবং অসংখ্য খ্রীষ্টানের মৃত্যু পোপের মর্যাদা নষ্ট করে। এই পটভূমিতে ইউরোপে ‘জাতি রাষ্ট্র’ গড়ে উঠতে শুরু করে। এইসব রাষ্ট্র তাদের এলাকায় পোপের কর্তৃত্ব মানতে রাজি ছিল না। এঁদের অনেকেই (যেমন, অষ্টম হেনরি) ধর্মসংস্কার আন্দোলনকে উৎসাহিত করেন।
৬) মানবতাবাদীদের প্রভাব :
নবজাগরণের প্রভাবে ইউরোপে মানবতাবাদী পন্ডিত ও জ্ঞানীগুণী পন্ডিত ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন জন ওয়াইক্লিফ, জন হাস, ইরাসমাস, মার্টিন লুথার, জন ক্যালভিন প্রমূখ। চার্চের দুর্নীতি ও অনাচারের বিরুদ্ধে এঁদের আপসীন মনোভাব ও কার্যকলাপ ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পথ সুগম করে দেয়।
৭) প্রত্যক্ষ কারণ — মার্টিন লুথারের প্রতিবাদ :
১৫১৭ সালে জার্মানিতে পোপের প্রতিনিধি ‘ইনডালজেন্স’ বা ‘মার্জনা পত্র’ বিক্রি করতে এলে মার্টিন লুথার তাঁর অনুগামীদের নিয়ে প্রতিবাদ শুরু করেন। এই ঘটনাকে ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের ‘প্রত্যক্ষ কারণ’ বলা হয়। কেননা, এই ঘটনার পরই জার্মানির বহু সামন্ত রাজা এবং সাধারণ মানুষ লুথারের সমর্থনে এগিয়ে আসেন। শুরু হয়ে যায় ইউরোপব্যাপি ধর্মসংস্কার আন্দোলন।
এভাবে, পঞ্চদশ শতকে ইতালিতে যে নবজাগরণ শুরু হয়েছিল তা যেমন ইউরোপকে নবযুগের আলো দেখিয়েছিল, তেমনি ষোড়শ শতকে জার্মানির ধর্মসংস্কার আন্দোলনে ইউরোপে মধ্যযুগের অবসান ঘটিয়ে আধুনিক যুগের আগমন বার্তা বয়ে এনেছিল।
-----------xx-----------
এই প্রশ্নটিই অন্য যেভাবে আসতে পারে :
- ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কারণ কী ছিল?
- কোন্ কোন্ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপে ধর্মবিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল?
- ‘ধর্মবিপ্লব’ কী? ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপে কেন ধর্মবিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল?
- ‘ধর্মসংস্কার আন্দোলন’ বলতে কী বোঝো? এই আন্দোলনের পিছনের কারণগুলি বিশ্লেষণ করো।
ধর্মসংস্কার বিষয়ে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন :
- ধর্ম সংস্কার আন্দোলন বলতে কী বোঝো?
- ইউরোপীয় ধর্ম-সংস্কার আন্দোলনের পটভূমি আলোচনা করো।
- ধর্মসংস্কার আন্দোলনে যান ওয়াই ক্লিপের অবদান কী ছিল?
- ধর্মসংস্কার আন্দোলনের জন হাসের ভূমিকা কী ছিল?
- ধর্মসংস্কার আন্দোলনে ইরাসমাসের অবদান কী ছিল?
- মার্টিন লুথারের পঁচানব্বই গবেষণাপত্র কী?
- ওয়ার্মসের সভা কী?
- অগসবার্গের সন্ধির শর্তগুলো কী ছিল?
- অ্যানাব্যাপস্টিক আন্দোলন কী?
- প্রতিসংস্কার আন্দোলন বলতে কী বোঝো?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন