নবজাগরণের ইতিবাচক প্রভাব কী ছিল?
নবজাগরণের ইতিবাচক প্রভাব কী ছিল? |
পঞ্চদশ শতকের ইতালির নবজাগরণ সমকালীন ইউরোপীয় সাহিত্য, শিল্পকলা, ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন ও সমাজ-সংস্কৃতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল। এই পরিবর্তন দু'ভাবে পরিলক্ষিত হয় - ইতিবাচক এবং নেতিবাচক।
নবজাগরণের ইতিবাচক প্রভাব :
নবজাগরণের ইতিবাচক প্রভাবগুলো হল :
- ইতিহাসচর্চায় প্রভাব : নবজাগরণের প্রভাবে ইতিহাস চর্চায় ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব হয়। এই নতুন ইতিহাস দর্শনের প্রবক্তা ছিলেন লিওনার্দো ব্রোনি, ফ্রানচেথকো গুইচিয়ারদিনি ও ফ্ল্যাবিও বিয়োন্দ।
- সাহিত্যচর্চায় প্রভাব : এতদিন ইউরোপে শুধুমাত্র গ্রিক, রোমান ও ল্যাটিন ভাষার চর্চা হত। কিন্তু নবজাগরণের কল্যাণে মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। সাহিত্যের বিষয় হিসেবে ঈশ্বর বন্দনার জায়গায় মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়া বিষয় হিসাবে গুরুত্ব পায়। দান্তে আলীগিরি, ফ্রান্সিস্কো পেত্রার্ক, জিওভান্নি বোকাচ্চিও, জিওফ্রে চসার, এডমান্ড স্পেন্সার, উইলিয়াম শেক্সপিয়ার প্রমুখ সাহিত্যিক এই পর্বে মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চা করে খ্যাতি লাভ করেন।
- শিল্পকলায় প্রভাব : নবজাগরণের প্রভাবে গ্রীক ও রোমান শিল্পকলার পুনরুজ্জীবন ঘটে এবং সেইসঙ্গে সৃজনশীলতার নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। নবজাগরণ প্রসূত মানবতাবাদের প্রভাবে শিল্পকলার চর্চায় ঐশ্বরিক ভাবনার পরিবর্তে মানুষ ও প্রকৃতি প্রাধান্য পায়। চিত্রকলায় লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাইকেল এঞ্জেলো, রাফায়েল প্রমূখ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ভাস্কর্য শিল্পে মাইকেল এঞ্জেলো, ভেরোকিও এবং স্থাপত্যের ক্ষেত্রে রাফায়েল এবং প্যালাডিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে প্রভাব : নবজাগরণের প্রভাবে মানুষের মনে যুক্তিবাদ ও মুক্তচিন্তার উন্মেষ ঘটে। ফলে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে নিত্যনতুন আবিষ্কারের পথ প্রস্তুত হয়। জোহানেস গুটেনবার্গ মুদ্রণ শিল্পে, রাজার বেকন রসায়ন, যন্ত্রবিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে অসামান্য অবদান রাখেন। ফ্রান্সিস বেকান প্রকৃতি বিজ্ঞান এবং লিওনার্দো দা ভিঞ্চি শরীর তত্ত্ব, জ্যোতির্বিদ্যা, দুর্গ নির্মাণ, খাল খনন ও উড়ো জাহাজের নকশা প্রস্তুত করে খ্যাতি অর্জন করেন। নিকোলাস কোপার্নিকাস এবং গ্যালিলিও গ্যালিলি যথাক্রমে জ্যোতির্বিজ্ঞানের নতুন তত্ত্ব এবং দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ধারণায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন।
- ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রভাব : নবজাগরণের প্রভাবেই উরোপে মানবতাবাদের জন্ম হয়। মানবতাবাদের প্রভাবে খ্রিস্টধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্বরূপ সম্পর্কে মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দেয়। আঞ্চলিক ভাষায় বাইবেল প্রকাশিত হলে সাধারণ মানুষ পোপ এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি ও ভন্ডামি সামনে আসে। ফলে শুরু হয় ধর্ম সংস্কার আন্দোলন।
- ভৌগলিক আবিষ্কারের প্রভাব : নবজাগরণের ফলে উদ্ভূত যুক্তিবাদ ও নৌ-কম্পাসের আবিষ্কার ইউরোপীয়দের ভৌগোলিক আবিষ্কারে উৎসাহিত করে। ফলে ১৪৯৮ সালে কলম্বাস কর্তৃক আমেরিকা আবিষ্কারের পর একের পর এক অজানা দেশ আবিষ্কার হতে থাকে। গড়ে ওঠে উপনিবেশ।
- অর্থনীতির উপর প্রভাব : নবজাগরণকে কেন্দ্র করে ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে ইউরোপীয়দের নব আবিষ্কৃত দেশগুলির সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্রুত প্রসার ঘটে। ফলে বাণিজ্যিক-পুঁজি বৃদ্ধি পায় এবং তা শিল্প উৎপাদনে বিনিয়োগ করলে শিল্প-পুঁজিতে রূপান্তরিত হয়। এভাবে ইউরোপে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির উদ্ভব ঘটে।
- রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রভাব : নবজাগরণের সূত্র ধরে বারুদের আবিষ্কার, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার এবং উপনিবেশগুলি থেকে প্রাপ্ত অর্থ বিনিয়োগের ফলে বণিক শ্রেণি সামন্ত শ্রেণিকে সরিয়ে রাজশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। বণিক শ্রেণির সমর্থনে রাজশক্তি শক্তিশালী হয়ে জাতির রাষ্ট্র গঠনে উদ্যোগ নেয়। ফলে ফ্রান্স, স্পেন, ইংল্যান্ড সহ ইউরোপের নানা দেশে জাতি রাষ্ট্র গড়ে ওঠে।
মূল্যায়ন :
এভাবে ইউরোপীয় নবজাগরণের ইতিবাচক প্রভাব ইতালি তথা সমগ্র ইউরোপ এবং পরবর্তীকালে বিশ্বের নানান দেশকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। জন্ম হয় এক আধুনিক বিশ্বব্যবস্থা।
-----------xx-----------
এই প্রশ্নটি অন্য যেভাবে আসতে পারে :
- নবজাগরণের ইতিবাচক ফলাফল আলোচনা করো।
- ইউরোপীয় নবজাগরণ বিশ্বব্যবস্থাকে কিভাবে প্রভাবিত করেছিল।
- ইতালির নবজাগরণ গুরুত্বপূর্ণ কেন?
- ইউরোপীয় নবজাগরণের ইতিবাচক তাৎপর্য সংক্ষেপে লেখো।
- ইতালির নবজাগরণ কীভাবে আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার জন্ম দেয়?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন