ক্রুসেড কী? ক্রুসেডের ফলাফল লেখো।
ক্রুসেডের ফলাফল আলোচনা করো |
সংসদ নমুনা প্রশ্ন — ২০২৪
১০৯৬ থেকে ১২৯১ সাল পর্যন্ত, প্রায় দু’শো বছর ধরে, জেরুজালেম পুনরুদ্ধারকে কেন্দ্র করে খ্রিস্টান ও মুসলিম শাসকদের মধ্যে যে তুমুল যুদ্ধ চলেছিল তা ‘ক্রুসেড’ বা ‘ধর্মযুদ্ধ’ নামে পরিচিত।
মধ্যযুগের ইউরোপের সমাজ, সভ্যতা, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি প্রভৃতির উপর ক্রুসেডের প্রভাব বা ফলাফল ছিল সুগভীর এবং সুদূরপ্রসারী।
রাজনৈতিক ফলাফল :
- সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয় : ক্রুসেডের যোগ দিয়ে সামন্ত প্রভুরা প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিল। ফলে সামন্ততন্ত্রের আর্থিক ভিত্তি নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া অসংখ্য ভূমিদাস ও বহু সামন্ত প্রভুর মৃত্যু হয়। ফলে সামন্ততন্ত্র ভেঙে পড়ে।
- জাতীয় রাষ্ট্রের গঠন : ক্রুসেড সামন্ত প্রভুদের অবক্ষয়ের সাথে সাথে রাজাকে শক্তিশালী করে তুলেছিল। ফলে রাজাদের অধীনে ইউরোপে একটি রাজনৈতিক ঐক্যের বাতাবরণ সৃষ্টি হয় যা জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের পথ সুগম করে দেয়।
অর্থনৈতিক ফলাফল :
- শিল্পের বিকাশ : ক্রুসেডের ফলে সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয়ের ফলে মধ্যযুগের সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির পরিবর্তন ঘটে এবং শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির বিকাশ ঘটে।
- বাণিজ্যের প্রসার : ক্রুসেডের ফলে ইউরোপীয় বণিকরা প্রাচ্যের সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। ফলে ইউরোপের বাণিজ্যের প্রসার এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটে।
- কুটির শিল্পের প্রসার : ক্রুসেডের ফলে সাধারণ কারিগরদের প্রাচ্যের দেশগুলির সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে এবং নতুন নতুন কলাকৌশল রপ্ত করে। ফলে কুটির শিল্পের উন্নতি ও প্রসার ঘটে।
- শহর ও বাণিজ্য কেন্দ্রের উদ্ভব : ক্রুসেডকে কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি ও প্রসারের ফলে ইউরোপ জুড়ে নতুন নতুন শহর ও বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে ওঠে।
সামাজিক ফলাফল :
- উদার মানসিকতার বিকাশ : ক্রুসেডে অংশ নেওয়ার ফলে ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ পায়। ফলে তারা একে অপরের রীতিনীতির পার্থক্য ভুলে নিজেদের মধ্যে এক ধরনের সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলে।
- শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি : ক্রুসেডের পর ভূমিধসরা মুক্তি পেলে গ্রামের কৃষিকাজ ছেড়ে তারা শহরের কলকারখানায় কাজের জন্য চলে আসে। ফলে গ্রামের জনসংখ্যা কমে যায় এবং শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
- শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব : গ্রাম থেকে ভূমি দাসরা শহরে কলকারখানায় যোগ দিলে তারা শিল্প শ্রমিকে পরিণত হয়। এভাবে শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে।
- বণিক ও মহাজনদের ক্ষমতা বৃদ্ধি : ক্রুসেটে যাওয়ার আগে সামন্ত প্রভুরা বণিক ও মহাজনদের কাছ থেকে প্রচুর ঋণ নেয়। সেই ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় তাদের জমিগুলি বণিক ও মহাজনদের হস্তগত হয়। ফলে সমাজে তাদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়।
- নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি : পুরুষেরা ক্রুসেডে অংশগ্রহণ করায় মৃত্যু অথবা দীর্ঘ সময় অনুপস্থিতির কারণে স্বামীর পরিবর্তে নারীরা পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পায়। ফলে তাদের সামাজিক সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
পোপের ক্ষমতা বৃদ্ধি :
- অবিসংবাদী ধর্মীয় নেতা : ক্রুসেড এর সময় পোপের আহ্বানে সামন্ত শ্রেণি নাইট এবং আপামর জনগণ যুদ্ধে যোগ দেন। ফলে, রাজা বা সম্রাট এর চেয়ে খ্রিস্টান জগতে নেতা হিসেবে পোপের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।
- অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি : অসংখ্য অভিজাত ব্যক্তি, সামন্ত প্রভু তাঁদের বিশাল সম্পত্তি ক্রুসেডের যাওয়ার আগে চার্চ-এর কাছে গচ্ছিত রেখেছিলেন। এদের অনেকেই যুদ্ধে মারা যায়। ফলে চার্তচ তথা পোপ বিপুল অর্থের মালিক হয়ে ওঠে।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন :
- ইসলাম সম্পর্কে ধারণার পরিবর্তন : ক্রুসেডের পরে ইউরোপীয়রা (পাশ্চাত্যের মানুষজন) উপলব্ধি করে যে, মুসলমানরা (প্রাচ্যের মানুষজন) দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিদ্যা, শিল্প বা সাহিত্য ইত্যাদিতে খুবই পারদর্শী। ফলে মুসলমানদের সম্পর্কে তাদের যে তীব্র বৃটিশরা এবং ঘৃণা ছিল তা দূর হয়।
- জ্ঞানের প্রসার : ক্রুসেড অনুন্নত ইউরোপীয়দের প্রাচ্যের উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘটায়। ফলে আরবীয়দের জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতার সংস্কৃতি ইউরোপীয় সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করে তোলে। উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক ভাবের আদান-প্রদান ঘটে।
- বাণিজ্যের প্রসার : ক্রুসেডের সূত্র ধরে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের এই মেলবন্ধনের ফলে উভয়ের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। ফলে উভয়ের মধ্যে আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য শুরু হয়।
- যুদ্ধ কৌশল আত্মস্থ করা : প্রাচ্যের (আরবীয়) যুদ্ধ কৌশল ক্রুসেডের সূত্র ধরেই ইউরোপীয়রা আত্মস্থ করে। দুর্গ নির্মাণ পদ্ধতি, পদাতিক বাহিনী দিয়ে শত্রুকে ঘিরে ধরা ইত্যাদি কৌশল শেখে।
ক্রুসেডের মূল্যায়ন :
এভাবে ইউরোপের জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে ক্রুসেডের প্রভাব গভীরভাবে পরিলক্ষিত হয়। ফলে, ইউরোপ এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়েনবির মতে, ক্রুসেডের ফলেই আধুনিক ইউরোপের জন্ম হয়।
-----------xx----------
এই প্রশ্নটি অন্য যে যে ভাবে আসতে পারে :
- ইউরোপের ইতিহাসে ক্রুসেডের প্রভাব আলোচনা করো।
- ক্রুসেড ইউরোপের জনজীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?
- মধ্যযুগের ইউরোপীয় ইতিহাসে ক্রুসেডের গুরুত্ব কতটা ছিল?
- ক্রুসেডের প্রভাব ও তাৎপর্য আলোচনা করো।
এই বিষয়ে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন :
- ক্রুসেডের সামাজিক কারণ কী ছিল?
- ক্রুসেডের অর্থনৈতিক কারণ কী ছিল?
- ক্রুসেডের উদ্দেশ্য কী?
- ক্রুসেডের প্রত্যক্ষ কারণ কী ছিল?
- ক্রুসেড কী? ক্রুসেডের ফলাফল আলোচনা করো।
- ক্রুসেডে নারীদের অবদান কী ছিল?
- ক্রুসেডের খ্রিষ্টানদের ব্যর্থতার কারণ কী ছিল?
- ক্রুসেডের ফলে পোপের ক্ষমতা কীভাবে বৃদ্ধি পায়?
- ক্রুসেড কীভাবে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন