ভৌগোলিক আবিষ্কারের কারণগুলো আলোচনা করো।
![]() |
ভৌগোলিক আবিষ্কারের কারণ |
ভৌগোলিক আবিষ্কার :
পঞ্চদশ শতকের ইউরোপে নবজাগরণ, বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ও নৌপ্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির ফলে ইউরোপীয়দের মধ্যে অজানাকে জানা এবং অচেনাকে চেনার অদম্য ইচ্ছা জেগে ওঠে। এই প্রেক্ষাপটে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মানুষ সামুদ্রিক অভিযানে অংশ নেয়। ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নতুন নতুন ভূখণ্ড বা দেশ আবিষ্কার হতে থাকে। নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কারের এই ঘটনা ‘ভৌগোলিক আবিষ্কার’ নামে পরিচিত।
এইভাবে সমগ্র পঞ্চদশ শতক জুড়ে ইউরোপীয়রা একের পর এক নৌ-অভিযানের মাধ্যমে পৃথিবীর নতুন নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কার করে। আর এই কারণে পঞ্চদশ শতকে ‘ভৌগোলিক আবিষ্কারের যুগ’ বলা হয়।
ভৌগোলিক আবিষ্কারের কারণ বা পটভূমি :
খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতক থেকে ইউরোপীয় দেশগুলি যে দুঃসাহসিক ভৌগোলিক অভিযান শুরু করে তার পিছনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ লক্ষ্য করা যায়।
- কৃষি ও শিল্পবিপ্লব : পঞ্চদশ শতকে নবজাগরণের প্রভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটে। নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির জন্ম হয়। এইসব প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ‘কৃষি ও শিল্প উৎপাদন ক্ষেত্রে বিপ্লব’ সংঘটিত হয়। ফলে শিল্পপণ্য উদ্বৃত্ত হতে শুরু করে। এই উদ্বৃত্ত শিল্প পণ্য বিক্রি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির প্রয়োজনে নতুন নতুন বাজার আবিষ্কার ও দখল জরুরী হয়ে পড়ে।
- কনস্টান্টিনোপলের পতন : ১৪৫৩ সালে তুর্কিদের হাতে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য তথা কনস্টান্টিনোপলের পতন ঘটে। ফলে ভূমধ্যসাগরের জলপথ ও স্থলপথ, দুই-ই ইউরোপীয় বণিকদের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে প্রাচ্যের দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ পুনরায় গড়ে তোলার জন্য নতুন পথের সন্ধান জরুরী হয়ে পড়ে।
- ভ্রমণ কাহিনী : মধ্যযুগের শেষ দিকে অনেক ইউরোপীয় ভ্রমণকারী চিন ও প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে সেখানকার কথা ইউরোপীয়দের কাছে তুলে ধরেন। ফলে এইসব দেশগুলির প্রতি তাদের আগ্রহ ও কৌতুহল বৃদ্ধি পায়। এই আগ্রহ ও কৌতূহল তাদের দুঃসাহসিক সামুদ্রিক অভিযানে যেতে উদ্বুদ্ধ করে।
- বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের আবিষ্কার : নবজাগরণের ফলে বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার প্রসার ঘটে। ফলে নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হতে থাকে। কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও প্রমুখ বৈজ্ঞানিকের আবিষ্কারের সূত্র ধরে নৌ-কম্পাস, অ্যাস্ট্রোলেব ইত্যাদি যন্ত্র আবিষ্কার হয়। ফলে ভৌগোলিক অভিযান সহজ হয়ে ওঠে।
- মানচিত্র অংকন : পঞ্চদশ শতকে আঁদ্রেওয়াল পারজার বিশ্ব মানচিত্র এবং ষোড়শ শতকে গারহার্ডাস মারকেটার ইউরোপের প্রথম আধুনিক মানচিত্র তৈরি করেন। এই মানচিত্র সামুদ্রিক অভিযানকে সহজসাধ্য করে তোলে।
- শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা : ভৌগোলিক আবিষ্কারে অগ্রসর হতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাজারা সে দেশের নাবিকদের উৎসাহ, প্রেরণা ও সাহায্য করতেন। এক্ষেত্রে পর্তুগালের রাজা দ্বিতীয় জন, স্পেনের রাজা ফার্দিনান্দ ও রানী ইসাবেলার পৃষ্ঠপোষকতায় সামুদ্রিক অভিযান উৎসাহিত হয়।
- চার্চের উৎসাহদান : ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা নাবিকদের সমুদ্র অভিযানে উৎসাহ দিতে শুরু করে। নতুন আবিষ্কৃত দেশগুলিতে খ্রিস্টানধর্মের প্রচার করাই তাদের মূল লক্ষ্য ছিল।
- জনসংখ্যা হ্রাস : চতুর্দশ শতকে ইউরোপে প্লেগের প্রাদুর্ভাব হলে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। ফলে, কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে শ্রমিকের ঘাটতি দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে সামুদ্রিক অভিযানের মাধ্যমে নতুন নতুন দেশ আবিষ্কার ও সেখানকার মানুষকে দাস মজুর হিসাবে আমদানি করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়।
- পর্তুগালের ভূমিকা : পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে পর্তুগালে একদিকে যেমন রাজনৈতিক সুস্থিতি ও শান্তি বজায় ছিল, তেমনি সে সময় সেখানে সোনার যোগান কমে যায়। এই রাজনৈতিক সুস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে পর্তুগাল সোনার যোগান বাড়াতে উদ্যোগ নেন। আর এই জন্যেই তিনি নাবিকদের ভৌগোলিক অভিযানে উৎসাহিত করেন।
- নাবিকদের দুঃসাহসিক মানসিকতা : পঞ্চদশ শতকের ইউরোপে বহু দুঃসাহসী নাবিক জন্মগ্রহণ করেন। তারা নিজেদের ব্যক্তিগত বীরত্ব ও জাতীয় গৌরব বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার জন্য সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার মত দুঃসাহসী কাজে আত্মনিয়োগ করত।
উপসংহার :
বস্তুত, সমকালীন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, বাণিজ্যের বিকাশ, প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি, নৌ-বিদ্যার অগ্রগতি, ধর্মীয় অনুপ্রেরণা,দুঃসাহসী নাবিকদের অদম্য ইচ্ছা ভৌগোলিক আবিষ্কারের পথ প্রশস্ত করেছিল।
------xx------
এই প্রশ্নটিই অন্য যেভাবে আসতে পারে :
- ভৌগোলিক আবিষ্কার বলতে কী বোঝো? পঞ্চদশ শতকের ইউরোপে ভৌগোলিক আবিষ্কারের পটভূমি ব্যাখ্যা করো।
- কোন সময়কে, কেন ভৌগোলিক আবিষ্কারের যুগ বলা হয়? এ প্রসঙ্গে ইউরোপের ভৌগোলিক আবিষ্কারের কারণ ব্যাখ্যা করো।
- পঞ্চদশ শতকে ইউরোপীয় নাবিকদের সমুদ্র অভিযানের কারণ কী ছিল?
সমুদ্র অভিযান সংক্রান্ত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন :
- ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলাফল বর্ণনা করো।
- নতুন বিশ্ব বলতে কী বোঝো? নতুন বিশ্বে করা কীভাবে উপনিবেশ গড়ে তোলে?
- ভৌগোলিক আবিষ্কারে ভাস্কোদাগামা,আমিরিগো ভেসপুচি ও কলম্বাসের অবদান সংক্ষেপে লেখো।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন