টমাস ক্রমওয়েলের কার্যাবলী / সংস্কারগুলোর মূল্যায়ন করো।
টমাস ক্রমওয়েলের কার্যাবলী মূল্যায়ন |
ইংল্যান্ডের টিউটর বংশের রাজা অষ্টম হেনরির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন টমাস ক্রময়েল। ‘নব্য রাজতন্ত্রে’ রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধিই ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য। এই লক্ষ্য পূরণে তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ (সংস্কার) করেছিলেন। এই পদক্ষেপগুলির মাধ্যমে টমাস ক্রমওয়েল যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছিলেন, তা ইংল্যান্ডের ইতিহাসে ‘টিউডর বিপ্লব’ নামে পরিচিত।
টমাস ক্রমওয়েল বিভিন্ন পদক্ষেপ / সংস্কার :
বিবাহ সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান :
অষ্টম হেনরির কোন পুত্রসন্তান ছিল না। এই পরিস্থিতিতে তিনি অ্যানবোলিন নামে এক মহিলাকে বিবাহ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তৎকালীন নিয়ম অনুযায়ী বর্তমান স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ও পোপের অনুমোদন ছাড়া এই বিবাহ বৈধ নয়। কিন্তু পোপ বিবাহবিচ্ছেদে অনুমোদন দিতে অস্বীকার করলে সমস্যা তৈরি হয়। এই পরিস্থিতিতে ক্রমওয়েল রাজার পুনর্বিবাহের অনুকূলে আইন (‘অ্যাক্ট অব অ্যাপিলস’) প্রণয়ন করে এই সমস্যার সমাধান করেন।
রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি :
রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য একাধারে তিনি পাঁচটি আইন পাশ করেন।
- ‘অ্যাক্ট অব অ্যানেটস’ পাশ করে যাজকদের আয়ের অংশ পোপের পরিবর্তে রাজাকে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
- ‘অ্যাক্ট অব সাকসেশন’ এর মাধ্যমে প্রথম স্ত্রীর কন্যা মেরিকে বঞ্চিত করে অনবলিনের সন্তানের উত্তরাধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
- ‘অ্যাক্ট অব সুপ্রিমেসি’র মাধ্যমে রাজাকে ধর্মাধিষ্ঠানের সর্বময় কর্তা ঘোষণা করা হয়।
- ‘অ্যাক্ট অব ট্ৰিজন’-এর মাধ্যমে রাজার বিরোধিতাকে রাজদ্রোহিতা হিসাবে গণ্য করা হয়।
পোপের ক্ষমতা হ্রাস :
পোপের ক্ষমতা হ্রাস করার জন্য টমাস ক্রমওয়েলের দুটি আইন প্রয়োগ করেন :
- ‘অ্যাক্ট অব অ্যাপিলস’ প্রনয়নের মাধ্যমে ইংল্যান্ডের যাজকদের বিচার সংক্রান্ত আপিল পোপের কাছে পাঠানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
- ‘রোমের বিশপদের ক্ষমতা বাতিলকরন আইন’-এর মাধ্যমে পোপের ক্ষমতা রক্ষার জন্য কেউ চেষ্টা করলে তার সম্পত্তি রাষ্ট্র বাজেয়াপ্ত করবে বলে ঘোষণা করা হয়।
পার্লামেন্টের ক্ষমতা বৃদ্ধি :
রাজতন্ত্রের সম্মান বৃদ্ধির পাশাপাশি ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টকেও তিনি শক্তিশালী করে তোলেন। তিনি রাজাকে নিয়েই ঘোষণা করান —
- রাজার সার্বভৌম ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতেই নিহিত।
- তিনি পার্লামেন্টের সদস্যদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, গ্রেফতারের হাত থেকে মুক্ত থাকা ইত্যাদি অধিকার দেন।
এভাবে ক্রময়েল ভবিষ্যৎ ইংল্যান্ডের জন্য ‘সীমাবদ্ধ রাজতন্ত্র’ এবং পার্লামেন্টের সুদীর্ঘ ক্ষমতার কাঠামোটি গড়ে তোলেন।
বাইবেলের অনুবাদ :
ইংরেজিতে অনুদিত এবং বিদেশে মুদ্রিত যেসব বাইবেল গোপনে ইংল্যান্ডে আনা হয়েছিল, তা ধ্বংস করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ক্রমওয়েল বাইবেলের ইংরেজি অনুবাদের জন্য মাইলস কভারডালকে দায়িত্ব দেন। ১৫৩৭ সালে ইংল্যান্ডে প্রকাশিত এই বাইবেল ‘গ্রেট বাইবেল’ নামে পরিচিত। এই গ্রন্থ ইংল্যান্ডের প্রতিটি চার্চে রাখা এবং ব্যক্তিগতভাবে জনগণকে কেনার অনুমতি দেয়া হয়।
মঠের প্রাধান্য ধ্বংস :
ইংল্যান্ডের মঠগুলির উপর রাজার আধিপত্য বিস্তারের জন্য টমাস ক্রমওয়েল দুইটি উচ্ছেদ আইন প্রণয়ন করেন।
- ‘দ্য সাপ্রেশন অফ রিলিজিয়াস হাউস এক্ট, ১৫৩৬’ : এই এক্ট-এর মাধ্যমে ২ ০ ০ পাউন্ডের কম বাৎসরিক আয় সম্পন্ন মাঠগুলিকে দুর্নীতির অভিযোগে ভেঙে দেন। এবং এদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন।
- ‘দ্য সাপ্রেশন অফ রিলিজিয়াস হাউস এক্ট, ১৫৩৯’ : এই আইনের মাধ্যমে ইংল্যান্ডের অবশিষ্ট নোটগুলিকে উচ্ছেদ করেন এবং তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে রাজার অধিকারে আনা হয়।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৫৩৬ সালে উত্তর ইংল্যান্ডে ‘পিলগ্রিমেস অফ গ্রেস’ নামে এক বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। টমাস প্রমোয়েল কঠোর হাতে এই বিদ্রোহ দমন করেন এবং বিদ্রোহের নেতাদের প্রাণদণ্ড দেন।
টমাস ক্রমওয়েলের সংস্কারের ফলাফল :
টমাস ক্রমওয়েলের এইসব সংস্কার কার্যের ফলে ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়।
প্রথমত : মঠ ব্যবস্থার উচ্ছেদের মাধ্যমে চার্চের সামগ্রিক বিষয়ের উপরে রাজার কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়।
দ্বিতীয়ত : মঠের সমস্ত সম্পত্তি সহজ শর্তে নিলামে বিক্রি করা হলে নতুন জমিদার শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে।
তৃতীয়ত : ছোট মাঠগুলো ধ্বংস হওয়ায় ইংল্যান্ডের দরিদ্র মানুষজনেরা অতিরিক্ত ধর্মকর প্রদানের হাত থেকে মুক্তি পায়।
চতুর্থত : এই ছোট মাঠ গুলির বিলুপ্তি ঘটলে এখানে নিযুক্ত বহু মানুষ বেকার হয়ে পড়ে।
পঞ্চমত : ইংল্যান্ডের এইসব প্রশাসনিক সংস্কারের জন্য একটি জাতীয় আমলা তন্ত্র গড়ে ওঠে। ১৯ জন মন্ত্রী কে নিয়ে গড়ে ওঠে প্রিভি কাউন্সিল।
ষষ্ঠত : ইংল্যান্ডে রাষ্ট্র ও চার্চ উভয়ের উপর রাজার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে রাজা ও পার্লামেন্ট উভয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
সপ্তমত : ‘অ্যাক্ট অ্যাপিলস’ এর মাধ্যমে ইংল্যান্ডকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়া হয়। ফলে জাতীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
টমাস ক্রমওয়েলের মূল্যায়ন :
বস্তুতপক্ষে, ইংল্যান্ডের আধুনিক শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর বিকাশে টমাস ক্রোমোয়েলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। রাজা ও পার্লামেন্টের ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। প্রকৃতপক্ষে তাঁর গৃহীত নীতির ফলেই ইংল্যান্ডে ‘নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে’র ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
--------xx-------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন