দিল্লির সুলতানি শাসন কী ধর্মাশ্রয়ী ছিল?
দিল্লির সুলতানি শাসন কী ধর্মাশ্রয়ী ছিল? |
ভারতে সুলতানি শাসন কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল? সুলতানি শাসনের প্রকৃতি সম্পর্কিত এই প্রশ্ন বিষয়ে ভারতীয় ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।
ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ, এ এল শ্রীবাস্তব, আর পি ত্রিপাঠি, রাম স্মরণ শর্মা প্রমুখ মনে করেন সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি ছিল ধর্মাশ্রয়ী। অন্যদিকে সতীশচন্দ্র, মোহাম্মদ হাবিব, ডাক্তার কুরেশি, কে এম আশরাফ, ডঃ নিজামী প্রমূখ ঐতিহাসিক-এর মতে, সুলতানি রাষ্ট্র ছিল ধর্মনিরপেক্ষ, সামরিক ও অভিজাতান্ত্রিক।
সুলতানি শাসন ধর্মাশ্রয়ী : পক্ষে যুক্তি
সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রকৃতি ধর্মাশ্রয়ী ছিল - এই মত প্রকাশকারী ঐতিহাসিকদের যুক্তি হল :
- শরীয়াতের প্রতি গুরুত্ব : সুলতানি শাসকরা ইসলামিক আইন অনুযায়ী শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করত। ডক্টর ঈশ্বরী প্রসাদের মতে, সুলতানি আমলের সামাজিক আইন গুলি ইসলামী ধর্মশাস্ত্র বা শরীয়তের বিধান অনুযায়ী লিপিবদ্ধ হয়েছিল।
- উলেমা শ্রেণীর গুরুত্ব : এই শাসনব্যবস্থায় উলেমা শ্রেণীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এবং ইসলামী শাস্ত্র ও আইন কানুন অনুযায়ী শাসন পরিচালিত হত। বলা হয়, উলেমা শ্রেণির দ্বারা নির্ধারিত শরীয়তি আইন মিনিং সুলতানরা দেশ শাসন করতেন।
- খলিফার প্রতি আনুগত্য : দিল্লির শাসকেরা ইসলামী জগতের প্রধান ধর্মগুরু ও শাসক খলিফার প্রতি অনুগত ছিল। কারণ, খলিফা ছিলেন সমগ্র ইসলামী জগতের প্রধান ধর্মগুরু ও শাসক। দিল্লির সুলতানেরা খলিফাকে প্রভু হিসেবে মেনে নিজেদের খলিফার ভৃত্য বলে পরিচয় দিতেন।
- ইসলামিক কর ব্যবস্থা : রাষ্ট্রের কর ব্যবস্থা ইসলামী শরীয়ত নির্দেশিত নীতিমালা মেনে কার্যকর করা হত। ডক্টর ঈশ্বরী প্রসাদ লিখেছেন, শরীয়তের বিধান অনুসারে সুলতানি রাষ্ট্রের কর ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল।
- অমুসলিমদের অধিকারহীনতা : সুলতানি আমলে অমুসলমান শ্রেণির তেমন কোন নাগরিক অধিকার ছিল না। কখনো কখনো তারা হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে সেখানকার ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করতেন। রোমিলা থাপারের মতে, এভাবে তারা নিজেদের অমুসলিম বিরোধী ভাবমূর্তি প্রকাশ করতেন। এছাড়া অমুসলিম নাগরিকদের কাছ থেকে জিজিয়া কর আদায় করা হতো।
সুলতানি শাসন ধর্মাশ্রয়ী : বিপক্ষে যুক্তি
কিন্তু যারা এই মতের বিপক্ষে, তাদের যুক্তি হল :
- স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী : ইসলামী আইন অনুযায়ী ঈশ্বর হলেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী এবং ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে খলিফা সরাসরি শাসন পরিচালনা করেন। কিন্তু সুলতানি শাসকরা খলিফাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত একটি স্বাধীন সামরিক ও অভিজাতান্ত্রিক শাসন কয়েম করেছিলেন।
- খলিফার প্রতি আপাত আনুগত্য : খলিফার প্রতি সুলতানদের আনুগত্য ছিল বাহ্যিক এবং নিয়মমাফিক। দেশের বাইরে এবং ভেতরে বৃহত্তম মুসলিম জগতের সমর্থন আদায়ের জন্য এটি একটি রাজনৈতিক কৌশল মাত্র। অনেকেই সেটুকুও দেখাতেন না।
- শরীয়তের নির্দেশ অমান্য : অধিকাংশ শাসক (ইলতুৎমিস, আলাউদ্দিন খলজী, মোহাম্মদ বিন তুঘলক প্রমুখ) শরীয়তী বিধান উপেক্ষা করে দেশ শাসন করেছেন।
- হিন্দু ঐতিহ্যের প্রতি মর্যাদা : ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরণী লিখেছেন, দিল্লি ও প্রাদেশিক রাজধানীতে হিন্দুরা দেবদেবীর মূর্তি পূজা করত এবং দিল্লিতে শোভাযাত্রা করে হিন্দুরা যমুনা নদীতে মূর্তি বিসর্জন দিত। ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র বলেছেন, জিজিয়া কর আদায়ের মাধ্যমে বলপূর্বক হিন্দুদের যেমন ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়নি, তেমনি তরবারির ভয় দেখিয়ে ও তাদের ধর্মান্তরিত করা হয়নি।
- হিন্দুদের প্রতি গুরুত্ব : ব্যবসা বাণিজ্য এবং প্রশাসনিক কাজকম্মে অমুসলিমদের কর্তৃত্ব বজায় ছিল। এছাড়া সমগ্র সুলতানি রাষ্ট্রের গ্রামীণ প্রশাসন রাজস্ব বিভাগ বিভাগের হিন্দুদের আধিপত্য ছিল।
- ইসলামী আইন অনুপস্থিত : মুসলিমদের প্রাঙ্গণ না দেওয়া, সুদ গ্রহণ নিষিদ্ধ করা, পৌত্তলিকদের বসবাস করতে না দেওয়া ইত্যাদি শরীয়তি বিধান দিল্লির সুলতানরা মেনে চলতেন না।
- উলেমা শ্রেণিকে উপেক্ষা : এ প্রসঙ্গে আলাউদ্দিন খলজির বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বিয়ানার কাজী মুঘিস উদ্দিনকে স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন, কোনটি শরীয়ত সম্মত আর কোনটি শরীয়তসম্মত নয়, তা আমি জানি না। রাষ্ট্রের পক্ষে যেটি মঙ্গলের ও প্রয়োজনের বলে মনে আমি মনে করি, আমি সেটাই করি।
মূল্যায়ন :
এসব তথ্যকে সামনে রেখে ঐতিহাসিক ডক্টর মুজিব সুলতানি রাষ্ট্রকে প্রকৃতিগতভাবে স্বৈরতান্ত্রিক বলে অভিহিত করেছেন। ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র বলেছেন, সুলতানি রাষ্ট্র ছিল সামরিক ও অভিজাতকের দ্বারা শাসিত রাষ্ট্র। প্রকৃতপক্ষে সুলতানি রাষ্ট্র ছিল সামরিক শক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং অভিজাতদের দ্বারা পরিচালিত একটি স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
-------xx------
এই বিষয়ে অন্যান্য প্রশ্ন ও উত্তর :
- দিল্লির সুলতানি শাসনের প্রকৃতি কী ছিল? প্রশ্নের মান - ৪
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন