ভৌগোলিক আবিষ্কারের সুদূরপ্রসারী ফলাফল আলোচনা করো
![]() |
ভৌগোলিক আবিষ্কারের সুদূরপ্রসারী ফলাফল |
ভৌগোলিক আবিষ্কার পৃথিবীর ইতিহাসের একটি যুগান্তকারী ঘটনা। কারণ, এর ফলাফল বা তাৎপর্য ছিল গভীর ও সুদূরপ্রসারী। প্রকৃত অর্থে পৃথিবীর চেহারাটাই পাল্টে গিয়েছিল এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে।
ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলাফল :
- ভৌগোলিক জ্ঞানবৃদ্ধি : ভৌগোলিক অভিযানের ফলে ইউরোপীয়দের ভৌগোলিক জ্ঞানের প্রসার ঘটে। ১) ম্যাগেলান ও তাঁর সঙ্গীদের অভিযানের ফলে প্রমাণিত হয় পৃথিবী চ্যাপ্টা নয়, গোলাকার। ২) উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার সহ পৃথিবীর বহু নতুন দেশ ও মহাদেশের কথা তারা জানতে পারে। ৩) আবিষ্কার হয় প্রাচ্যে যাওয়ার জলপথ।
- প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক : ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে নতুন দেশগুলির সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ইউরোপীয়দের পরিচয় ঘটে। এই পরিচয় সূত্রে উভয়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান শুরু হয়।
- নতুন বাণিজ্য পথ : এতদিন ভূমধ্যসাগর ও তার তীরবর্তী অঞ্চল ছিল ইউরোপের বাণিজ্য ও সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র। ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে বাণিজ্যিক যোগাযোগের নতুন পথ হিসেবে আটলান্টিক মহাসাগরের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।
- ক্রীতদাস আমদানি : ভৌগোলিক আবিষ্কারের সূত্র ধরেই এশিয়া ও আফ্রিকার সাধারণ মানুষদের বন্দী করে তাদের ক্রীতদাসে পরিণত করা হয়। ফলে দাস ব্যবসার উদ্ভব হয়। শুধু পর্তুগালেই প্রতিবছর গড়ে ৮০০ জন আফ্রিকান ক্রীতদাস আমদানি করা হত।
- উপনিবেশ স্থাপন ও শোষণ : ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে ইউরোপীয় দেশগুলি এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ স্থাপনের সুযোগ হয়। এর ফলে একদিকে ইংল্যান্ড, পর্তুগাল, স্পেন, হল্যান্ড পরস্পরের মধ্যে ঔপনিবেশিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। অন্যদিকে, এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলি ইউরোপীয়দের উপনিবেশে পরিণত হয়। শুরু হয় উপনিবেশ শাসনের নামে আর্থ-সামাজিক শোষণ ও নির্যাতন।
- ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার : নতুন নতুন দেশ ও জলপথ আবিষ্কারের ফলে ইউরোপে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। নতুন এই দেশগুলি থেকে কাঁচামাল ও অন্যান্য সম্পদ আহরণের সুযোগ ঘটে। সেই সঙ্গে কাঁচামাল সংগ্রহ ও শিল্পপণ্য বিক্রির সুযোগ ঘটে।
- একচেটিয়া বাণিজ্যের সুযোগ : ভৌগোলিক আবিষ্কারের সূত্র ধরেই ইউরোপীয়রা প্রাচ্যের বণিক গোষ্ঠীগুলিকে গায়ের জোরে হটিয়ে দিয়ে সমুদ্রপথে একচেটিয়া বাণিজ্যের সূচনা করে। সেই সঙ্গে ইউরোপীয় দেশগুলি পরস্পরের মধ্যে বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে পড়ে।
- অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি : ভৌগোলিক আবিষ্কারের সূত্র ধরেই ইউরোপীয়রা প্রচুর পরিমাণে সোনা ও রুপো হস্তগত করে। উপনিবেশগুলিতে নতুন কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কৃষির উন্নতি ঘটিয়ে আর্থিক সমৃদ্ধির পথকে প্রশস্ত করে।
- ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিকাশ : ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে বাণিজ্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপের বাণিজ্যিক ব্যবস্থায় মহাজনি প্রথার বিলোপ ঘটে এবং বিভিন্ন যৌথ বাণিজ্যিক সংস্থা গড়ে ওঠে। এগুলি ক্রমে আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিকাশ ঘটায়।
- খ্রিস্টধর্মের প্রসার : ভৌগোলিক আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে খ্রিস্টান ধর্মের প্রচারকরা নতুন দেশগুলিতে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের পরিকল্পনা করে। ফলে ইউরোপের বাইরে খ্রিস্টান ধর্মের প্রসার ঘটে।
- ইউরোপীয়দের মর্যাদা বৃদ্ধি : ভৌগোলিক আবিষ্কারে সফল হওয়া দেশগুলির মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। সামুদ্রিক অভিযানের পৃষ্ঠপোষকতা করে বিভিন্ন দেশের রাজাদের সম্মান, মর্যাদা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়।
- মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব : সামুদ্রিক অভিযানের সূত্র ধরে ইউরোপে শিল্প ও বাণিজ্য অর্থনীতির বিকাশ ঘটে। ফলে দেশে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বুর্জুয়া শ্রেণির আবির্ভাব হয়। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রগতিশীল ভাবনা-চিন্তা ইউরোপে বিপ্লববাদের জন্ম দেয়। ফরাসি বিপ্লবসহ একাধিক বিপ্লবের এরাই ছিলেন কুশিলব।
উপসংহার :
প্রকৃতপক্ষে ভৌগোলিক আবিষ্কারের প্রধান লক্ষ্য ছিল ১) নতুন দেশ জয় ও তাদের ধনসম্পদ লুট করা। ২) ঐ সমস্ত দেশের মানুষকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করা। এবং ৩) এর মাধ্যমে গৌরব অর্জন করা। এই আবিষ্কার যেমন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের মেলবন্ধন ঘটায়, তেমনি কুফল হিসেবে দাস ব্যবসা ও উপনিবেশিক শাসন ও শোষণের পথ প্রশস্ত করে।
----------xx---------
এই প্রশ্নটিই যেভাবে ঘুরিয়ে আসতে পারে :
- ভৌগোলিক আবিষ্কারের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
- ভৌগলিক আবিষ্কারের গুরুত্ব বর্ণনা করো।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন