রুশোর রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে আলোচনা করো।
রুশোর রাষ্ট্রদর্শন ও তার মূল্যায়ন |
আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জগতে এক অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব হলেন ফরাসি চিন্তাবিদ ও দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাঁক রুশো। তাঁর রাষ্ট্রদর্শন পরবর্তীকালে ইউরোপের জ্ঞানদীপ্তির যুগ এবং বিশেষত ফরাসি বিপ্লবকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
রুশোর রাষ্ট্রদর্শনের উৎস :
প্লেটোর প্রভাব :
রুশোর রাষ্ট্রচিন্তার ওপর প্লেটোর চিন্তাধারার গভীর প্রভাব পড়েছিল। প্লেটোর রাজনৈতিক আনুগত্য, যা আইন ও শক্তির উৎস হিসাবে বিবেচিত এবং লোকসমাজ, যা নৈতিক মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করে। রুশো প্লেটোর এই মৌলিক চিন্তাধারার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বলেছিলেন, "সমাজ ছাড়া ব্যক্তির পক্ষে কোনও ক্ষমতা অর্জন সম্ভব নয়।"
লকের প্রভাব :
অন্যদিকে জন লকের স্বাভাবিক অধিকার, সম্মতির তত্ত্ব, লোকসমাজের সর্বভৌমিকতা প্রভৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ল্যাস্কির মতে, "রুশোর শিক্ষাটি লকের খনন করা চ্যানেলের একটি বিস্তৃত সমাপ্তি মাত্র।" ("Rousseau's teaching is only a broad endingof the channel dug by Locke.") তবে, মনে রাখতে হবে, লকের তত্ত্বের বেশ কিছু ত্রুটি সংশোধন করে তিনি তাঁর তত্ত্বে গ্রহণ করেছিলেন।
মন্তেস্কুর প্রভাব :
এছাড়া, রাষ্ট্রচিন্তাবিদ মন্তেস্কুর সাংবিধানিকতার তত্ত্বও তিনি তাঁর তত্ত্বে গ্রহণ করেছিলেন।
রুশোর রাষ্ট্রতত্ত্ব ও তার বৈশিষ্ট্য :
রুশো তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট, ডিসকোর্স অন দ্য ওরিজিন অফ ইনইকুয়ালিটি, ডিসকোর্স অন দ্য মোরাল এফেক্ট অফ আর্টস এন্ড সাইন্স ইত্যাদি গ্রন্থে। এগুলো থেকে আমরা তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার কিছু বৈশিষ্ঠ্য খুঁজে পাই :
- প্রকৃতির রাজ্য : রুশোর মতে প্রকৃতির রাজ্য হল ভূস্বর্গের মতো, যেখানে মানুষে মানুষে কোন অশান্তি বা বিদ্বেষ নেই; আছে মধুর ও আন্তরিক সম্পর্ক, আছে সুখ ও শান্তি। তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে চিন্তা ও বিচার শক্তির উন্মেষ ঘটলে পারস্পরিক ভেদাভেদ সৃষ্টি হয় এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব ঘটে। এর ফলে প্রকৃতির রাজ্যে সুখ ও শান্তি বিনষ্ট হয়।
- সামাজিক চুক্তি : প্রকৃতির রাজ্যে সৃষ্টি হওয়া এই অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে জনগণ নিজেদের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদন করে। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে রাজনৈতিক ব্যবস্থা। রুশো এই চুক্তির নাম দিয়েছেন ‘সামাজিক চুক্তি’ বা সোশ্যাল কনট্রাক্ট। এই চুক্তির হাত ধরে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রস্তুত হয়।
- স্বাধীনতা জন্মগত : রুশো তাঁর ‘Discourse on the origin of inequality’ গ্রন্থে বলেছেন, মানুষ সমান অধিকার নিয়ে জন্মায় এবং সমাজ ব্যবস্থা তাকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ‘সোশ্যাল কন্টাক্ট’ গ্রন্থে তিনি তাঁর এই মত আরও স্পষ্ট করে লেখেন, “মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মায় এবং সমাজের সর্বত্র সে শৃঙ্খলে আবদ্ধ।”
- সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব : রুশোর সামাজিক চুক্তি মতবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ‘সাধারণ ইচ্ছাতত্ত্ব’ বা ‘General will’ । রুশোর মতে, সাধারণ জনগণের ইচ্ছাই হল প্রকৃত শক্তি। তিনি জনগণের এই ইচ্ছাকে দু'ভাগে ভাগ করেছেন ‘প্রকৃত ইচ্ছা’ এবং ‘বাস্তব ইচ্ছা’ ব্যক্তি ইচ্ছা। প্রকৃত ইচ্ছা হল মানুষের মৌলিক, বিশুদ্ধ ও স্বভাবগত ইচ্ছা যা আসলে সকল মানুষের মঙ্গল করার ইচ্ছা। রুশো বলছেন, সাধারণ ইচ্ছা হল জনগণের এই সব প্রকৃত ইচ্ছাগুলির গুণফল।
- সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব : রুশোর ব্যাখ্যায়, এই সাধারণ ইচ্ছাই হল সার্বভৌম ক্ষমতা। কোন ব্যক্তি বা সরকার এই ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে না। তাঁর মতে, এই ক্ষমতা হল অহস্তান্তরযোগ্য, সমষ্টিগত স্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত, অবিভাজ্য, চরম ও চূড়ান্ত এবং অবশ্যই অভ্রান্ত।
- আইন ও আইন প্রণেতা : সর্বসাধারণের এই ইচ্ছাকেই রুশো আইন বলে অভিহিত করেছেন। এবং বলেছেন, যে প্রজারা আইনের আনুগত্য মেনে নেয়, কেবলমাত্র তাদেরই আইন প্রণেতা হওয়া উচিত।
- শাসনব্যবস্থা বা সরকার : রুশোর মতে, রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দুটি পৃথক ক্ষমতার অস্তিত্ব রয়েছে। একটি আইন প্রণয়নকারী ক্ষমতা যা সার্বভৌম এবং অন্যটি শাসন বিভাগীয় ক্ষমতা। শাসন বিভাগ বা সরকারের দায়িত্ব হল শাসক ও প্রজার মধ্যে যোগসূত্র রক্ষা করা। এই সরকারকে তিনি তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন : গণতান্ত্রিক, অভিজাততান্ত্রিক এবং রাজতান্ত্রিক। সেই সঙ্গে তিনি বৃহদায়কার রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে রাজতন্ত্রকেই সবচেয়ে উপযুক্ত শাসনব্যবস্থা বলে চিহ্নিত করেছেন।
রুশোর রাষ্ট্রতত্ত্বের মূল্যায়ন :
রুশো রাজতন্ত্রকে সবচেয়ে উপযুক্ত শাসন ব্যবস্থা বললেও রাজার স্বৈরাচারী শাসনের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, রাজা যদি স্বৈরাচারী হয়, সামাজিক চুক্তি অনুযায়ী, প্রজাদের অধিকার আছে রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করার। কারণ, এই চুক্তি অনুযায়ী জনগণের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধানের বিনিময়ে রাজা শাসন ক্ষমতা লাভ করেন। এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে তিনি শাসক হওয়ার যোগ্যতা হারান।
এভাবে রুশো জনগণের ইচ্ছাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে আধুনিক জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের পথ সুগম করেছিলেন। এ কারণে অধ্যাপক হার্নস রুশোর রাষ্ট্রচিন্তার প্রশংসা করে বলেছেন, “রাজনৈতিক আদর্শবাদীদের মধ্যে রুশো উচ্চস্থানের অধিকারী।”
--------xx-------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন