ইক্তা ব্যবস্থার বিবর্তন আলোচনা করো।
ইক্তা কী ? ইক্তা ব্যবস্থার বিবর্তন |
ইক্তা কী :
সুলতানি যুগে ভারতের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা ইক্তা নামে পরিচিত ছিল। ‘ইক্তা’ শব্দের অর্থ হল ‘এক অংশ’ বা ‘এক ভাগ’। ঐতিহাসিক ড. ইরফান হাবিবের মতে, “ইসলামের বিধান অনুসারে কৃষকের উৎপন্ন ফসলের উদ্বৃত্তের একাংশ কর হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং তা প্রাদেশিক মুসলিম শাসকদের মধ্যে বন্টন করা হয়। এই প্রথাকে ইক্তা প্রথা বলা হয়।”
ইক্তা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য :
সুলতান ইলতুতমিস ভারতে ইক্তা ব্যবস্থার প্রচলন করেন। এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল মূলত :
- সুলতানি অধিকৃত অঞ্চলগুলির উপর কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
- সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটানো।
- সাম্রাজ্যে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করা।
- আমির-ওমরাহদের সন্তুষ্ট করে সাম্রাজ্যে বিদ্রোহের আশঙ্কা দূর করা।
ঐতিহাসিক কে.এ. নিজামি লিখেছেন, “ভারতের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য দিল্লির প্রথম দিকের তুর্কি সুলতানগন বিশেষ করে ইলতুৎমিস ইক্তা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন।”
ইক্তা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য :
ইক্তা ব্যবস্থাকে বিশ্লেষণ করলে এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় :
১) ইক্তাদার :
ইক্তা ব্যবস্থা অনুযায়ী কৃষকের উৎপন্ন ফসলের উদ্বৃত্ত অংশের একাংশ রাষ্ট্রের প্রাপ্য ছিল। এই প্রাপ্য অংশ যিনি আদায় করতেন তাকে বলা হতো ইক্তাদার।
২) জমির মালিকানা :
ইক্তাদার কৃষকের কাছ থেকে ভূমি রাজস্ব ছাড়া অন্য কোন কিছুর দাবি করতে পারতেন না। কারণ, জমির মালিকানা ইক্তাদার নয়, ছিল সুলতানের হাতে।
৩) রাজস্ব নির্ধারণ :
ইক্তাদার রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণ করতে পারতেন না। এমনকি কৃষক ইচ্ছা করলে নিজে রাজদরবারে উপস্থিত হয়ে তার অবস্থা বা সমস্যার কথা জানাতে পারতেন।
৪) ইক্তাদারের শাস্তি :
ইক্তা ব্যবস্থার আইনকানুন লংঘন করলে সুলতান তাকে শাস্তি দিতে পারতেন এমনকি তার ইফতা বাজেয়াপ্ত করতেন।
৫) ইক্তাদারের দায়িত্ব :
ইক্তাদারের দায়িত্ব হল রাজস্ব আদায় করা, নিজের এলাকার প্রশাসন পরিচালনা ও শান্তির শৃঙ্খলা রক্ষা করা, এবং প্রয়োজনে বিদ্রোহ দমনে সুলতানকে সেনাবাহিনী দিয়ে সাহায্য করা।
৬) বদলির ব্যবস্থা :
সুলতান প্রয়োজন মনে করলে ইক্তাদারকে এক ইক্তা থেকে অন্য ইক্তায় বদলি করে দিতেন।
৭) ইক্তাদারের নিয়োগ :
ইকাদারের নিয়োগ পদচ্যুতি সুলতানের উপর নির্ভরশীল ছিল। সুলতানের বিরাগভাজন হলে তাকে পদচ্যুত হতে হতো।
৮) বংশানুক্রমিক নয় :
ইক্তা ব্যবস্থা বংশানুক্রমিক ছিল না। তবে পরবর্তীকালে তা বংশানুক্রমিক হয়ে পড়েছিল।
ইক্তা ব্যবস্থার বিবর্তন :
সুলতান ইলতুৎমিস ভারতে সর্বপ্রথম ইক্তা ব্যবস্থা প্রচলন করেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে এই প্রথায় সংস্কার ও বিবর্তন ঘুটতে থাকে।
১) ইলতুৎমিস ও ইক্তা ব্যবস্থা :
ইলতুৎমিস এই প্রথা চালু করার পরপরই তাকে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের যন্ত্রে পরিণত করেন। তাদের বদলির ব্যবস্থা এবং সৈন্য দিয়ে সুলতানকে সাহায্য করাকে বাধ্যতামূলক করেন।
২) বলবন ও ইক্তা ব্যবস্থা :
ইক্তাদদের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া আটকাতে বলবন
- খোয়াজা নামে এক ধরনের হিসাব পরীক্ষক নিয়োগ করেন।
- রাজস্ব জমা কিংবা সামরিক সাহায্য দিতে অসমাপ্ত হলে একটা ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
৩) আলাউদ্দিন খলজি ও ইফতার ব্যবস্থা :
সুলতান আলাউদ্দিন খলজী —
- সেনাদের ইক্তার পরিবর্তে নগদ বেতন দানের প্রথা চালু করেন। যদিও সেনাপতিদের ইত্যাদি আর রীতি চালু থাকে।
- জরিপ করে ইফতার রাজস্বের হার নির্ধারণ করেন।
৪) গিয়াস উদ্দিন তুঘলক ও ইক্তা ব্যবস্থা :
গিয়াস উদ্দিন তুঘলক আলাউদ্দিন খলজির কর কাঠামোকে অপরিবর্তিত রেখে এর কঠোরতা হ্রাস করেন।
৫) বিন তুঘলক ও ইক্তা ব্যবস্থা :
পূর্বে ইক্তাদারের প্রধান দায়িত্ব ছিল দুটো। একটি রাজস্ব আদায় করা এবং অন্যটি সৈন্যদের ভরণ পোষণ করা। কিন্তু বিন তুঘলক এই দুটি দায়িত্ব দুজন ব্যক্তির উপর ন্যস্ত করেন।
৬) ফিরোজ শাহ তুঘলক ও ইফতার ব্যবস্থা :
ফিরোজ শাহ তুঘলক
- ইক্তা প্রথাকে বংশানুক্রমিক করার ব্যবস্থা করেন।
- ইফতার হিসাব পরীক্ষায় শিথিলতা আনেন।
- সেনাদের বেতনের পরিবর্তে খাস জমি দেয়ার ব্যবস্থা করেন।
ইক্তা ব্যবস্থার ত্রুটি :
ইক্তা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কিছু ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা যায়।
১) ইকাদাররা অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে
২) সামন্ততন্ত্রের কুফল গুলি দূর করার পরিবর্তে একসময় সামন্ততন্ত্রের ত্রুটি বিচ্যুতি এই প্রথার মধ্যে ঢুকে পড়ে।
৩) খাস জমি ইক্তার অন্তর্ভুক্ত করায় সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কমে যায়।
৪) ফিরোজ তুঘলকের আমলে ইক্তা বংশানুক্রমিক হওয়ার ফলে ইক্তাদদের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রবণতা বাড়ে।
ইক্তা ব্যবস্থার মূল্যায়ন :
এই সমস্ত ত্রুটি সত্ত্বেও ইক্তা ব্যবস্থার গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।
প্রথমত, ইক্তদারদের উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ করায় শহরগুলির শ্রী বৃদ্ধি ঘটতে থাকে।
দ্বিতীয়তঃ ইক্তা ব্যবস্থার ফলে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে রাজ কোষের সমৃদ্ধি ঘটে।
তৃতীয়ত, ইক্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ দৃঢ় হয় এবং সাম্রাজ্যের ভিত্তি শক্তিশালী হয়।
চতুর্থত, অভিজাত শ্রেণির মানুষদের ইক্তা প্রদান করায় তাদের অসন্তোষ দূর হয়। সাম্রাজ্য সুস্থিতি বজায় থাকে।
পঞ্চমত, এই ঈদটা ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে মুঘল আমলের জায়গীরদারী ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
ঐতিহাসিক কে.এ. নিজামীর মতে, সুলতানি সাম্রাজ্যের নব বিজিত এলাকাগুলো থেকে রাজস্ব আদায় করা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং দূরবর্তী অঞ্চলগুলিকে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের অঙ্গিভূত করা প্রভৃতি সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়েছিল ‘ইক্তা ব্যবস্থার’ মাধ্যমে।
--------xx-------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন